Magic Lanthon

               

সনৎকুমার সাহা

প্রকাশিত ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

প্রায় অনধিকার চর্চা

সনৎকুমার সাহা


[২৯ বছর আগে এক মেধাবী মানুষ শিল্পের এক অনন্য মাধ্যম চলচ্চিত্র নিয়ে চিঠি লিখেছিলেন আরেক মেধাবী মানুষকে। এ কথা এই প্রজন্মের অনেকেরই হয়তো অজানা। তারা হয়তো জানেই না, বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে নতুন নয়। সবসময়ই চলচ্চিত্র বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সম্প্রতি সাহিত্যে একুশে পদক পাওয়া সনৎ কুমার সাহা ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্র নিয়ে তার উদ্বেগ-চিন্তা-মত-স্বপ্নের কথা লিখেছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ মুহম্মদ খসরুর কাছে। বিষয় ছিলো মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ধ্রুপদী ৫ম সংকলন, আগস্ট ১৯৮৫র পর্যালোচনা। এতো বছর পরও চলচ্চিত্র নিয়ে সেই আলোচনা নতুন প্রজন্মের কাছে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই পুনঃপ্রকাশ।]

 

মুহম্মদ খসরু,

প্রীতিভাজনেষূ,

রীতিমত অবাক হয়েছি। মফস্বলে থাকি। আপনাদের চলচ্চিত্র আন্দোলন থেকে যোজন যোজন দূর। কখনো সখনো ছবি দেখি। নিয়মিত ভাল ছবি দেখার সুযোগই বা কই? ছবি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে গেলে, আগে, তার কলাকৌশলের দিকগুলো মোটামুটি জানা থাকা দরকার। ক্যামেরা নিয়ে কত রকম যে কসরৎ, আগিয়ে-পিছিয়ে, ওপর-নীচ করিয়ে তা থেকে যে কত বিচিত্র মায়া রচনা, প্রত্যক্ষে আলোছায়া আর রঙের জগৎ থেকে বক্তব্য ও বোধের মনের মতো প্রতিমা তুলে আনা, আর একই সঙ্গে তাতে ধ্বনিতে গতিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা, এর কোনটিই অশিক্ষিত পটুতা বরদাস্ত করে না। যেহেতু এসবই আমার আয়ত্তের বাইরে, তাই ছবি নিয়ে কোন কথা বলা আমার পক্ষে অনেকটাই অনধিকার চর্চা।

অবশ্য ইদানীং লক্ষ্য করি, কোন একটা বিশেষ কিছু ঘটলে সাধারণ মানুষের ওপর তার কি প্রতিক্রিয়া ঘটলো, তা কেউ কেউ যাচাই করে দেখেন। খবরের কাগজওয়ালারা এমনটি করে থাকেন হামেশাই। বাজারের ওঠানামা নিয়ে যাঁদের মাথাব্যথা, তাঁরাও ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দের গতি-প্রকৃতির ওপর নজর রাখতে তাঁদের মতামতের যথেষ্ট মূল্য দেন। ঘটনা যাঁরা ঘটান, তাঁরা জানতে চান, সাধারণ মানুষ তাঁদের কাণ্ডকারখানা মেনে নিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্ম হবে কি না। যাঁরা বাজারে জিনিশ ছাড়েন, তাঁরা দেখতে চান, সে জিনিশ বাজারে চলবে কি না। চললেও কত দরে। নিতান্ত আনাড়ি মানুষের মতামতও তাই গুরুত্ব পায়। উৎপাদক বা স্রষ্টা হিশেবে নয়, গোটা কর্মকাণ্ডের কর্তা হিসেবে নয়, বরং ভোক্তা বা উপভোক্তা হিশেবে, যা কর্মেরই একটা অংশ।

আমার মনে হয়, ছবি নিয়ে কথা বলা আমার পক্ষে অনেকটাই অনধিকারচর্চা হলেও কিঞ্চিৎ অধিকার যদি থেকে থাকে তবে তা এই ভাবেই। ক্রিয়ায় নয়, প্রতিক্রিয়ায়। এবং বোধহয়, আপনারাও সেইটুকু মনে রেখেছেন। তাতে আমি কৃতার্থ। যদি কিছুটা বিব্রতও। অনভ্যস্ত দর্শকের দেহাতি মতামত হাস্যকর হয়ে পড়ার আশংকা থাকে।

ধ্রুপদী, এই সংকলনটি (৫) ইতিমধ্যেই দেশে গুণীজনদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আলোচনা থেকে বোঝা যায়, কিভাবে তা সবার প্রশংসা কুড়োচ্ছে। সংকলনের লেখাগুলো যে শুধু মূল্যবান ও সময়োপযোগী, তাই নয়, আমাদের চিন্তাভাবনাকেও তারা দারুণভাবে নাড়া দেয়। একটানা ঝিমুতে ঝিমুতে আমরা হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে উঠে বসি। চোখ কচলে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিই। অন্তত ভালমন্দ বিচার বিবেচনাগুলো ঝালাই করে নিতে চাই। এর চেয়ে বেশি কিছু হয় কি না জানিনে। হলে সেটা খুবই আনন্দের। তবে না হলেও কৃতজ্ঞ বোধ করি। আমরা যে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের সৎ ও কল্যাণকর মানবমুখী সৃষ্টিভাবনার কয়েকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণের সঙ্গে পরিচিত হই, এটা কম পাওয়া নয়। তারই বিপরীতে আমাদের সংস্কৃতি জগতের ব্যর্থ বিবর্ণ বিশ্রী চেহারা যে আপনাকে কতদূর বিচলিত করে, তা আপনার লেখা পড়েই বোঝা যায়। আপনার রাগী মন্তব্যগুলোর পেছনে হয়ত আপনার উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাই কাজ করে।

তবে সবার সব লেখার সব জায়গাতেই যে একমত হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আসলে তারা যে আমাদের চিন্তাকে উসকে দিয়ে, এমন কি তর্কের ভেতরেও টেনে আনে, এটুকুও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সৎ ও সৃষ্টিশীল কাজে কেউ যদি পথের ইংগিত বা প্রেরণা পায়, তবে তা হবে এক বিরাট কাজ। বইটি পড়তে পড়তে কখনো কখনো নানা কথা আমার মনে জেগেছে। সহানুভূতি থাকলেও সহমতে আসতে পারিনি কোথাও কোথাও।

সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সম্পর্ক নিয়ে হাসান আজিজুল হক ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাবনা যেন একই খাতে বয়। তফাৎটা মনে হয়েছে শুধু মাত্রার। হাসান অবশ্য আরো একটু গভীরে যেতে চেষ্টা করেছেন। ছবি সাহিত্যের বশ্যতা না করলেও তাতে সাহিত্যের অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তাকে তাঁরা দুজনেই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। সুনীল অনেকটা খোলাখুলি। হাসান বিকল্প সম্ভাবনাকে উপেক্ষা না করেও। তবে দুজনেই বিবেচনার জন্য বেছে নেন শ্রেষ্ঠ নির্মাতাদের চলচ্চিত্র। আমার মনে হয়, বিষয়টি একটু সাধারণ স্তরে নামিয়ে আনলে আমাদের জন্যে তা আরো বেশী প্রাসঙ্গিক হবে। বাংলাদেশে এখন যা অবস্থা তাতে শ্রেষ্ঠ ছবি নিয়ে আলাপ আলোচনার পাশে পাশে কি করে রুচিশীল সাধারণ ভাল ছবি তৈরী করা যায়, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। শ্রেষ্ঠ ছবি যার তার হাতে যখন তখন তৈরী হয় না। অন্তত আমাদের দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতিনিধিত্বও তা করে না। হঠাৎ কখনো তেমন কোন ছবি তৈরীর সম্ভাবনা দেখা দিলে তা হবে নেহাতই দলছুট একটা ব্যাপার। অন্য দিকে গোটা শিল্পটা কুরুচি আর স্থূলতার পাঁকে ডুবুডুবু। তাকে তুলে আনাটাই প্রথম সামাজিক দায়িত্ব। রুচির স্তরটা ওপরে তুলে আনতে পারলে শ্রেষ্ঠ ছবি তৈরীর ক্ষেত্রটাও প্রশস্ত হয়।

এইখানে আমার মনে হয়, আমাদের দেশের দর্শকদের জন্যে পরিচ্ছন্ন রুচিশীল গল্পের ভূমিকা অসাধারণ। একটা গল্প গুছিয়ে ছবিতে গতিময় করে বলতে পারা, এইটুকু পারলেও কিন্তু অনেকটা এগুনো যায়। নাইবা থাকলো তাতে আধুনিক সিনেমাটোগ্রাফির কারিকুরি। নাইবা থাকলো তথাকথিত আধুনিক জীবন যন্ত্রনার মারপ্যাঁচ। ভেবে দেখুন আমাদের আজকের বাংলা ছবির কথা। আজগুবি কাহিনী আর আড়ষ্ট সংলাপের দুর্বলতা ঢাকার জন্যে কত রকমের হৈহুল্লোড়। অথচ একটা গল্প এবং গল্পই, তরতরিয়ে বলতে পারার জন্যে অনেক কিছু শিখতে হয়না। অবশ্য কাণ্ডজ্ঞানটুকু থাকা চাই। আর অভিনয়ের গুরুত্বটা বুঝতে হয়। কাহিনীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠায়, দর্শকদের ধরে রাখায় অভিনয়ে জোর, সংলাপ উচ্চারণ ও প্রক্ষেপণে, নৈপুণ্য, এগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। বলা যেতে পারে, প্রাথমিক শর্ত।

একটু খেয়াল করে দেখুন, বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে আজ যে দৈন্যদশা, তার এক বড় কারণ হলো কাহিনীর গুরুত্ব হ্রাস। শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিম বাংলাতেও। অথচ সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রের একটা ঐতিহ্য কিন্তু প্রথম থেকেই গড়ে উঠছিল। গল্প-উপন্যাসকে ছবিতে উপস্থাপনাই যেন চলচ্চিত্রের ছিল প্রধান কাজ। সংলাপের ওপর জোর আর অভিনয় কুশলতা এদুটো ছিল তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ছবির পরিচালক আজকের অর্থে হয়ত স্রষ্টা ছিলেন না। কিন্তু ছবিতে কাহিনী ভালভাবে বলতে পারলে তা দর্শক টানতো। অসাধারণ অভিনেতা অভিনেত্রীরাও নিজেদের নৈপুণ্য দেখাবার সুযোগ পেতেন। দর্শকরা তাঁদের মনে রাখত। প্রমথেশ বড়ূয়া, ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী, চন্দ্রাবতী, এঁদের কথা মনে করুন। সেই ধারাতেই পরে উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন ইত্যাদি। কিন্তু এদের পরে, অর্থাৎ গত বিশ বছরের ভেতরে সাধারণ বাংলা ছবিতেও প্রতিভাহীন পরিচালকেরা যখন সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে চাইলেন, তখন কাহিনী, অভিনয়, দুটোই হয়ে পড়ল গৌণ। বাংলা ছবি তার নিজস্ব বিকাশের স্বাভাবিক ধারা থেকে বিচ্যুত হলো।

আপাতবিরোধী হলেও এর একটা কারণ কিন্তু, আমার মনে হয়, সৃষ্টিশীল প্রতিভাধর পরিচালকদের আবির্ভাব। সত্যজিৎ ঋত্বিকের ছবি যখন আক্ষরিক অর্থে তাঁদের ছবি হয়ে ওঠে, তখন চুনোপুঁটিরাও ভাবতে থাকেন, তাঁরাও নানা রকম কায়দা দিয়ে ছবিতে একেবারে তাঁদের নিজস্বতার ছাপ মেরে দেবেন। প্রতিভাহীন ছবি করিয়ের হাতে গোটা ব্যাপারটাই তালগোল পাকিয়ে যায়। সেকেলে হবার ভয়ে না পারেন তাঁরা সোজাসুজি গল্প বলার চেষ্টা করতে। প্রতিভার অভাবে না পারেন সত্যিকার সৃষ্টিশীল হতে। ছবির নামে যে জগাখিচুড়ি বেরিয়ে আসে, তা স্বধর্মচ্যুত হয়েও কাউকেই সন্তুষ্ট করে না।

একটা কথা, মনে হয়, ভেবে দেখা দরকার। যাঁদের সত্যিকারের প্রতিভা আছে এবং তাঁদের সংখ্যা সব সময়েই নগণ্য, তাঁরাই শুধু চলচ্চিত্রকে একটা সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম হিসেবে বেছে নিতে পারেন। যাঁদের তা নেই তাঁরা যদি সাহিত্যের বশ্যতা মেনে নিয়ে গুছিয়ে ভালভাবে একটা গল্প ছবিতে ধারাবাহিক বলবার চেষ্টা করেন, তবে সেইটিই সব দিক থেকে মঙ্গলজনক। আর ছবি যিনিই করুন, আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধরনটাও তিনি নিশ্চয় মনে রাখবেন। যে ঐতিহ্যে শিল্প কল্পনা প্রবল ভাবে কাহিনী নির্ভর, এবং যা আদৌ হীনগুণ নয়, তাকে প্রত্যাখান করা যেকোন চলচ্চিত্র পরিচালকের পক্ষেই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে। পাশ্চাত্য নবতরঙ্গের মোহে শিকড়হীন শিল্প রচনার কসরৎ কতটুকু সফল হতে পারে, ভেবে পাইনা। জাপানের কুরোশোয়া বা ওজুর যে অল্পকটি ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি, তাতে নিজস্ব ঐতিহ্যে আত্মস্থ থেকেই চলচ্চিত্র মাধ্যমে যে তাঁরা অনন্য সাধারণ সৃজন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও কি তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট নয়? সত্যজিৎ না হয়েও, স্রষ্টা না হয়েও আমাদের সাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা আমাদের কাহিনীর ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করে এই মাধ্যমটিকে টিকিয়ে রাখতে পারেন। নিজেরাও টিকে যেতে পারেন।

বাংলা সাহিত্যে মহাশ্বেতা আমার অন্যতম প্রিয় লেখক। তাঁর ঝকঝকে তেজি গদ্য, আপোষহীন জিদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদ, এ সবই আমাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু ইদানীং মনে হয়, তাঁর ‘ইমেজ’ তাঁকে বন্দী করে ফেলছে। ফল দাঁড়ায় এই-একটা জায়গায় তিনি আটকে থাকছেন। এবং প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের বাস্তব ক্ষেত্র অন্যত্র সরে গেলেও তিনি তাঁর অভ্যস্ত জায়গা থেকেই একই নামতা বার বার পড়ছেন। তাঁর মত সচেতন সাহিত্যিকের এভাবে আটকা পড়ে যাওয়া আমাকে খুব দুঃখ দেয়। কারণ প্রত্যাশা ছিল তাঁর কাছে অনেক বেশী। ভায়োলেন্স্ তাঁর প্রিয় বিষয়, এটা খুব স্মার্ট শোনায়। কিন্তু যাদের অবলম্বন করে ভায়োলেন্স্-এর ছবি তিনি দেখতে চান, তাঁদের কীর্তিকলাপ খুঁটিয়ে দেখলে সংশয় জাগে, এ্যানার্কি আর সমাজ বিপ্লব, এই দুটোকে তিনি এক করে গুলিয়ে ফেলছেন না ত? এ্যানার্কি কিন্তু প্রতিবিপ্লবের ও প্রতিক্রিয়াশীলতার পথই প্রশস্ত করে। একটা এ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট অবস্থান নেবার পরে অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই হয়ত তাঁর চোখে পড়ছেনা। কিন্তু পড়া উচিৎ ছিল। কারণ তিনি অর্জন করতে চলেছিলেন মহত্ত্বের দুর্লভ অধিকার।

এই প্রসঙ্গে আরো একটা প্রশ্ন সামনে আনি। বিষয়টা অবশ্য সংকলনে অন্যত্র ভিন্নভাবে এসেছে। কথাটা হলো, রাজনৈতিক ছবি বলতে আমরা কি বুঝি? সে কি শুধুই একটা পক্ষ নিয়ে লড়াই করার কথা বলা? অথবা সে কি কেবলই সমাজে শোষক আর শোষিতের পূর্বনির্ধারিত ভূমিকার অনিবার্য পরিণামকে স্পষ্ট করে তোলা? এগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ছবি বলতে যদি শুধু এইটুকুই বুঝি, যদি পার্টিজান হওয়াটাই শিল্পের পরাকাষ্ঠারও শেষ কথা ভাবি, তবে তার সীমা খুবই সংকীর্ণ হয়ে যায় না কি? আসলে রাজনৈতিক ছবি বলতে শুধু এইটুকুই বোঝায়, এটা মানতে বেশ কষ্ট হয়। রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তনের বা পরিবর্তনহীনতার যে গিঁটগুলো আছে, তাদের ভেতরে শিল্পীর পছন্দমত কোন কোনটির ওপর সন্ধানী আলো ফেলা, মানুষে মানুষে সম্পর্কে যে ক্রমাবনতি¾স্বার্থপরতায়, বিতৃষ্ণায় ও বিবমিষায় যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন, তাকে মানব সম্পর্কের বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির উপস্থাপনে ঠিক ঠিক চিনিয়ে দেওয়া, এও কিন্তু প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনই।

সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবিই এদিক থেকে গভীরভাবে রাজনৈতিক। দেবী, জলসাঘর, পরশ পাথর বা কাঞ্চনজঙ্ঘার মত প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক ছবির কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু সীমাবদ্ধ বা জনঅরণ্যের মত ছবি ত স্পষ্টতই রাজনৈতিক। এবং মনে তারা দাগ কাটে শ্লোগানধর্মী ছবির চেয়ে অনেক বেশী গভীরে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় টিকে থাকা আর বড়ো হওয়ার প্রতিযোগিতা মানুষকে কিভাবে ‘ডি-হিউম্যানাইজ’ করতে থাকে, তার গভীর তাৎপর্যময় এমন ছবি খুব বেশী তৈরী হয়েছে বলে মনে হয় না। আর বাচ্চাদের ছবি হলেও ‘হীরক রাজার দেশে’র স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী বক্তব্য সে সময় আমাদের দেশে দর্শকদের ওপর যে কি প্রচণ্ড ছাপ ফেলেছিল, তা নিশ্চয় আপনারও মনে আছে। ‘ঘরে বাইরে’ আমি দেখিনি। তবে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে অনুমান করা যায়, এবং বিভিন্ন সমালোচনা থেকেও বুঝতে পারি, সেখানেও একটা রাজনৈতিক অবস্থান নেবার ব্যাপার আছে, যার মূল থেকে যায় নৈতিক মূল্যবোধের গভীরে। অপ্রিয় হবার আশংকা থাকলেও এমন অবস্থান নিতে রবীন্দ্রনাথ পিছ-পা হননি। হননি সত্যজিৎও। এইখানেই তাঁদের সততা। তবে শুধু সততায় ছবি মহৎ হয়না। তাকে শিল্পোত্তীর্ণও হতে হয়। আর সব ছবির বেলায় যেমন, রাজনৈতিক ছবির বেলাতেও একথা সত্য। শ্লোগানকে যাঁরা বেশী মূল্য দেন, একথাটা অনেক সময় দেখি, তাঁরা ভুলে যান।

মহিলা চলচ্চিত্রকারদের ওপর হাসনা বেগমের লেখা ‘চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে নারী’ একটি মূল্যবান রচনা। অনেকের সম্পর্কে জানা গেল। আমি অবশ্য মাত্র দুজন পরিচালকের ছবি দেখেছি। তাও একটি একটি করে। এ্যাইনেস ভারদার ‘লে বনহুর’; আর অপর্ণা সেনের ‘থার্টি সিক্স্ চৌরঙ্গী লেন’। দুটো ছবিই অসাধারণ। দৃষ্টিনন্দন তো বটেই। সেই সঙ্গে পরিচালকের স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ছবি দেখার পর তার রেশ থেকে যায় বহুদিন। ছবির ভাষার ওপর দুজনের দখলই প্রবল বিস্ময় জাগায়। আর সেই সঙ্গে সঙ্গীতের অপূর্ব প্রয়োগ। এতদিন পরেও আমার মুগ্ধতা কাটে না।

তা সত্ত্বেও কিন্তু কথা থাকে। বিশেষ করে ছবির বক্তব্য নিয়ে। ভারদা তো মানুষী অভিজ্ঞতার বিচিত্র অনুভবের গভীরে আমাদের টেনে নিয়ে চলেন। ব্যতিক্রমধর্মী বলে ভয় পাননা। কিন্তু আমরা বড় রকমের একটা হোঁচট খাই বই কি! হাসনা বেগম উল্লেখ করেছেন, ছবির মূল বক্তব্য, বাঁচা মানেই সুখী হয়ে বাঁচা। সেই সুখের স্বরূপ কেমন? কিভাবে কোন আধারে ভারদা তাকে উপলব্ধির বৃত্তে স্থাপন করেন। আমরা দেখি লক্ষ্মী স্ত্রী আর ফুলের মত দুই বাচ্চা নিয়ে এক সুখী কাঠ মিস্তিরিকে। অন্য এক মেয়ের প্রেমে পড়ে সে আরো সুখী। সুখ যেন এ্যাডিটিভ। ঘরের সুখ আর বাইরের সুখ যোগ করে তার বাড় বাড়ন্ত। অকপটে সে বউকে বলে তার বাড়তি সুখের কথা। বউ কিন্তু এতে তার আপন সুখের ঘরটাই ভেঙে পড়তে দেখে। সে আত্মহত্যা করে। লোকটা ভেবে পায় না, যত বেশী মানুষী সম্পর্ক, ততবেশী সুখ, এই কথাটি তার বউ কেন বুঝলোনা। সে তো তার বউকে কম ভালবেসে আর একজনকে ভালবাসতে যায়নি। বউ-এর মৃত্যু অবশ্য তার সুখী হবার আকাক্সক্ষার ওপর কোন ছায়া ফেলেনা। সে তার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে অন্য মেয়েটির সঙ্গে ঘর বেঁধে আবার সুখের সাগরে ডুব দেয়।

এই যে প্লাস্টিক মানুষ আর তার প্লাস্টিক সুখ, ইচ্ছামত সরল রেখায় যার হ্রাস বৃদ্ধি-এ নিয়ে স্বাভাবিকতা ও সারল্যের এক অকৃত্রিম উৎসের দিকে মানুষের অগ্রসর হবার ছবিটা হয়ত আমরা পেতে পারি, কিন্তু তা কি মূলত দায়িত্বহীন জীবনের স্বার্থপরতার প্রতিফলন মাত্র নয়, এবং সেটা কি নয় সুখের নামে তার বিকৃতিরই অন্বেষণ? ভারদার ‘সুখ’ চোখকে যতটা তৃপ্তি দেয়, মনকে ততটা উজ্জীবিত করে না। ধর্মের ষাঁড় আর যাই হোক, কোন অর্থবহ জীবনের সত্য বাণীর প্রতিনিধি নয়।

‘থার্টি সিক্স্ চৌরঙ্গী লেন’-এ অপর্ণা সেনের কাজ অবিস্মরণীয়। এ অঞ্চলের ছবিতে নিঃসন্দেহে তিনি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে তাঁর নিজস্বতার¾এক বিরল সফিস্টিকেশন, আরবেনিটি ও পারঙ্গমতার ছাপ। তবু মনে হয় ছবিতে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলার একাকিত্ব যেন অনেকখানি বাইরে থেকে আরোপিত, কিছুতেই ভেতর থেকে পুরোপুরি সত্য হয়ে ওঠেনা। এ কি মেয়ে হিসেবে অপর্ণা সেনের বাস্তবতার গভীরে সবটুকু দেখতে পারায় কোন সীমাবদ্ধতা, অথবা, মেয়ে হিসেবেই দেখতে পারার এ এক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য? জানিনা।

পরের ছবি ‘পরমা’য় নাকি অপর্ণা আরো পরিণত। আর ভীষণ সাহসী। ছবি না দেখে সে সম্পর্কে কথা বলা ঠিক নয়। তবে এই ছবি প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অপর্ণা সেনের কোন কোন মন্তব্য আমাকে ভাবিয়ে তোলে। কেবল ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তির পূর্ণতা তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির একৈকান্ত সম্পর্কের অভিজ্ঞতার পথেই তিনি মনে করেন, ঘটতে থাকে তার আত্মোপলব্ধি। এইভাবে তিনি দেখান, অন্য পুরুষের সঙ্গে খাঁটি সম্পর্ক একটি মেয়েকে তার স্বামী সন্তান সংসার ছাড়িয়ে সার্থকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। যা আমাকে ভাবায় তা এই কাহিনী নয়, কাহিনীর বক্তব্য। মানুষের ইতিহাসে তার অভিযাত্রা ত শুধু ব্যক্তির পূর্ণতা অর্জনে নয়, এই পূর্ণতাকে অতিক্রম করাতেও। সে সত্য তার একাকিত্বে নয়, তার সোশ্যাল মিল্যুতে¾সব মিলিয়ে হয়ে ওঠাতে। এই সোশ্যাল মিল্যুর গুরুত্ব নিয়ে অপর্ণা সেন ভাবেন বলে মনে হয়না। ভাবলেও উপেক্ষা করেন। এটা কিন্তু ভাল লক্ষণ নয়। মানুষ ও প্রকৃতির অসংখ্য সম্পর্ক-সম্বন্ধে একজন মানুষ বাঁচে। একদিকে পা বাড়ালেই অন্যদিকে টান পড়ে। সেটাও দেখা দরকার।

এই সংকলনে ইয়েভতুশেঙ্কোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ফেলিনী সিনেমার জন্যে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করেছেন। ফেলিনীর পক্ষে এটা করা হয়ত অসংগত নয়। কারণ মনন ও মেধার যে গুণ একজনকে শিল্প সাহিত্যের যেকোন অঙ্গনে অসাধারণ করে তুলতে পারে, তা তাঁর নিজের একটু বেশী পরিমাণেই আছে। সাহিত্য যা দিতে পারে তিনি নিজেই তা ভেবে নিতে পারেন। সাধারণ মাপের ছবি করিয়েদের বেলায় তা সত্য নাও হতে পারে। সেখানে আক্ষরিক অর্থে ফেলিনীর অনুসরণ করতে গিয়ে তাঁদের নিজেদের বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনাই বেশী। তাছাড়া ফেলিনীর মানস গঠনেও সাহিত্যের ভূমিকা ত কম নয়। ইয়েভতুশেঙ্কোর অন্য এক প্রশ্নের জবাব থেকে জানতে পাই, কি বিপুল ও সমৃদ্ধ তাঁর সাহিত্য পাঠ। আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম, শেক্স্পীয়রের অনুরাগী পাঠক কুরোশোয়া। শেক্স্পীয়রের বিপুল প্রতিষ্ঠা সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্র জগতেও। আমাদের চলচ্চিত্রকাররা কি সাহিত্য পাঠে নিজেদের এভাবে কখনো তৈরী করেন? অন্য সাহিত্য বাদই দিলাম। বাংলা ক্লাসিকই কি তাঁদের টানে। তার গুরুত্ব কি তাঁরা বোঝেন? আপনার, মাহমুদুল হকের লেখা থেকে বুঝি, অবস্থাটা কেমন ভয়াবহ।

তবু সবিনয়ে একটা কথা নিবেদন করি। রাগ যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তবে তা কিন্তু পরিণামে নিজেকেই বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। সবাই ত দোষে-গুণে মানুষ। ‘ফলিব্ল্’ অবশ্যই। এইটি মেনে নিয়ে বোঝার ও বোঝাবার চেষ্টা করলে কি কিছু পেতে পারি না?

আপনারা নিজেদের বৃত্তে অনেক দিচ্ছেন। কৃতজ্ঞ বোধ করি। আরো পাবার আশা রাখি।

জয় হোক আপনাদের।

 

সনৎ কুমার সাহা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী

 

দায়স্বীকার : সনৎকুমার সাহা’র ‘প্রায় অনধিকার চর্চা’ শিরোনামের এই চিঠিটি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের ফিল্ম বুলেটিন ‘চলচ্চিত্রপত্র’তে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত। ‘চলচ্চিত্রপত্র’ সম্পাদনা করেছেন মুহম্মদ খসরু ও মাহবুব আলম।


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন